হলি আর্টিজান হামলার পরে আলোচনায় আসে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির নাম। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষক ও শিক্ষার্থী জঙ্গি তৎপরতায় জড়িত এমন অভিযোগ ওঠে। বিশেষ করে হলি আর্টিজানের ঘটনায় গ্রেপ্তার এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক হাসনাত করিমের জঙ্গি কানেকশনও অনেক দিন ধরে আলোচনায় ছিল। যদিও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী শেষমেষ হলি আর্টিজান হামলায় তার সংশ্লিষ্টতা না পাওয়ায় তাকে চার্জশিটভুক্ত করেনি এবং আদালত তাকে অব্যাহতি দেন।
হলি আর্টিজান হামলার ৮ মাস পরে নর্থ সাউথের একজন শিক্ষার্থীকে মারধরের প্রতিবাদে ক্ষুব্ধ সহপাঠীদের তীব্র প্রতিক্রিয়ার প্রতিক্রিয়ায় দেশের একটি প্রভাবশালী গ্রুপের কয়েকটি গণমাধ্যম যেভাবে ওই শিক্ষার্থীদের ঢালাওভাবে ‘জঙ্গি’ তকমা দিয়ে তাদের ছবি প্রচার করে, তাতে এই প্রশ্নটিই সামনে আসে যে, চাইলেই যে কেউ যে কাউকে জঙ্গি আখ্যা দিতে পারে কি না? কাউকে জঙ্গি বলে তার ছবি প্রচারের অধিকার গণমাধ্যমের আছে কি না বা থাকা উচিত কি না? যতক্ষণ পর্যন্ত না আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিষয়টি নিশ্চিত করে যে, অমুক লোক জঙ্গি অথবা জঙ্গিবাদী কর্মকা-ে সম্পৃক্তÑতার আগে কোনো সংবাদমাধ্যম এভাবে জঙ্গি লিখতে বা প্রচার করতে পারে কি না?
গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, ২০১৭ সালের পয়লা মার্চ বুধবার রাত ১০টার দিকে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার মধ্যে অ্যাপোলো হাসপাতালের সামনে নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির বিবিএ’র ছাত্র শাহরিয়ার হাসনাতসহ কয়েকজন একটি মোটর বাইক রাখতে গেলে বসুন্ধরার নিরাপত্তারক্ষীরা বাধা দেন৷ এ নিয়ে বাদানুবাদের এক পর্যায়ে নিরাপত্তারক্ষীরা শাহরিয়ারকে মারপিট করেন৷ পরে তাকে উদ্ধারে নর্থ সাউথের আরো কয়েকজন শিক্ষার্থী সেখানে গেলে তারাও মারপিটের শিকার হন। আহত শাহরিয়ারকে প্রথমে অ্যাপোলো এবং সেখান থেকে ঢাকা মেডিকেলে পাঠানো হয়৷
মারধরের ঘটনায় রাতেই নর্থ সাউথের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করেন৷ পরদিন বৃহস্পতিবার সকাল ১০টা থেকে শিক্ষার্থীরা আবারো বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় জড়ো হয়ে বিক্ষোভ করেন৷ বেলা আড়াইটা পর্যন্ত তারা বিক্ষোভ ও ভাঙচুর অব্যাহত রাখেন৷ বিক্ষোভের সময় তারা প্রগতি সরণি অবরোধ করেন৷ বসুন্ধরা গ্রুপের কর্পোরেট অফিসেও ভাংচুর চালানো হয়। বিকেলে ফের সেখানে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয়।
ঘটনার পর ৩ মার্চ ওই গ্রুপের একটি পত্রিকার প্রধান শিরোনাম: ‘অপপ্রচার চালিয়ে জঙ্গি তা-ব’। খবরে বলা হয়, গুজব ছড়িয়ে বুধবার গভীর রাতে এবং পরদিন সকালে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় তা-ব চালায় ‘মুখোশ পরা বহিরাগত জঙ্গিরা’। ওই সংবাদে লেখা হয়, ‘গুলশানে রক্তাক্ত হামলাসহ দেশে বেশ কয়েকটি জঙ্গি হামলার ঘটনার পর রাজধানীর বারিধারায় বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এলাকাটির কয়েকটি গেট রাতে বন্ধ রাখা এবং নিয়মিত তল্লাশিসহ বেশ কিছু নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে পুলিশের পক্ষ থেকে। এই নির্দেশনা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে উগ্রপন্থী জঙ্গিগোষ্ঠীর ভয়ংকর তা-বের শিকার হয়েছে রাজধানীর এই শান্তিপূর্ণ অভিজাত আবাসিক এলাকা বসুন্ধরা। পরে র্যাব-পুলিশ এবং বসুন্ধরা গ্রুপের সতর্ক তৎপরতায় আরেকটি বড় ধরনের পরিকল্পিত জঙ্গি হামলার অপচেষ্টা রুখে দেওয়া সম্ভব হয়েছে।’
এই সংবাদে আরও বলা হয়, ‘গুলশানে রক্তাক্ত জঙ্গি হামলাসহ বেশ কয়েকটি ঘটনায় নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থীর জড়িত থাকার প্রমাণ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশে জঙ্গিদের সংগঠিত হওয়ার তথ্য পাওয়ায় র্যাব-পুলিশ-গোয়েন্দারের পক্ষ থেকে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর নজরদারি বাড়ানো হয়েছে আগেই। পাশাপাশি রাজধানীর বারিধারায় বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এলাকাটির কয়েকটি গেট রাতে বন্ধ রাখা এবং নিয়মিত তল্লাশিসহ বেশ কিছু নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে পুলিশের পক্ষ থেকে। এই নির্দেশনা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে উগ্রপন্থী জঙ্গিগোষ্ঠীর ভয়ংকর তা-বের শিকার হয়েছে রাজধানীর শান্তিপূর্ণ অভিজাত আবাসিক এলাকা বসুন্ধরা। পরে র্যাব-পুলিশ এবং বসুন্ধরা গ্রুপের সতর্ক তৎপরতায় আরেকটি পরিকল্পিত বড় ধরনের জঙ্গি হামলার অপচেষ্টা রুখে দেওয়া সম্ভব হয়েছে।’
এই সংবাদে ঘটনার যে বিবরণ দেয় তা এরকমÑ‘বুধবার রাত আনুমানিক ১২টার দিকে এ্যাপোলো হসপিটালের সামনে তপু নামে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্র মোটরসাইকেল নিয়ে আসেন। এই সময় আনসারের এক সদস্য বাধা দেন। এই নিয়ে দুইজনের বাকবিত-া চলে। পরে ওই ছাত্র ক্ষিপ্ত হয়ে আনসার সদস্যকে গালাগাল করতে থাকেন। ওই আনসার সদস্য প্রতিবাদ করেন। এক পর্যায়ে তাঁকে মারতে এলে আনসার সদস্য ছাত্রকে ধাক্কা দেন। ওই ছাত্র তাঁর কয়েকজন সহপাঠীকে ফোন করে ঘটনাস্থলে নিয়ে আসেন। সবাই মিলে আনসার সদস্যকে মারতে থাকেন। চিৎকার শুনে আশপাশের লোকজন এগিয়ে এলে ছাত্র পরিচয়ধারীরা তাদের ওপরও হামলা চালানোর চষ্টো করে। এমনকি আনসার সদস্যের রাইফেল পর্যন্ত কেড়ে নেওয়ার চষ্টো করে। পরে বসুন্ধরা কর্তৃপক্ষ এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। ছাত্রকে এ্যাপোলো হসপিটালে ভর্তি করা হলেও তাঁর আঘাত গুরুতর না হওয়ায় তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়। সবকিছু যখন শান্ত হয়ে আসছিল তখন একদল নামধারী ছাত্র এ্যাপোলো হসপিটালের পশ্চিম পাশের রাস্তার কোনায় জড়ো হয়ে পরিস্থিতি উত্তপ্ত করে তোলে। খবর পেয়ে পুলিশ ও র্যাব ঘটনাস্থলে ছুটে আসে। তাঁরা যুবকদের বুঝিয়ে স্থান ত্যাগ করার অনুরোধ করেন। কিন্তু সমবেতরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বসুন্ধরা গ্রুপের বিরুদ্ধে উস্কানিমূলক শ্লোগান দিতে থাকে। তাদের কর্মকা- ও আচরণ দেখে সংশ্লিষ্টরা তাদেরতে জঙ্গি হিসেবে চিহ্নিত করে।’ সংবাদের ভাষ্য অনুযায়ী, কথিত স্থানীয়রা হামলাকারী যুবকদের জঙ্গি হিসেবে চিহ্নিত করেছে বলে পত্রিকাও তাদের জঙ্গি বলে উল্লেখ করেছে!
যদিও একইদিন এই গ্রুপের আরেকটি পত্রিকার সংবাদে ওই যুবকদের ‘চিহ্নিত জঙ্গি’ বলে উল্লেখ করা হয়। ‘রহস্যময় তা-বে ওরা কারা: দিনভর ভাঙচুর, চিহ্নিত কিছু জঙ্গি ছিল তৎপর’Ñশিরোনামের খবরে বলা হয়, ‘হামলার আগে ও পরে বিভিন্ন সময় সাধারণ ছাত্রদের খেপিয়ে তুলতে ছাত্ররূপী জঙ্গিরা সাধারণ ছাত্রদের জন্য বিভিন্ন কৌশল প্রয়োগ করে। সমবেত ছাত্রদের উদ্দেশ করে তারা বলতে থাকে, ‘রক্ত কি খেলে না? কতক্ষণ আর আমরা চুপ করে থাকব?’ প্রত্যুত্তরে কয়েকজন বলতে থাকে, ‘অবশ্যই।’
এই সংবাদে দাবি করা হয়, হামলায় উসকানিদাতাদের একজন শাহজাদা। যার সাথে হিযবুত তাহরীরের সম্পৃক্ততা রয়েছে বলে অভিযোগ আছে। তিনি ভিডিও লাইভে বলেন, ‘ইনশা আল্লাহ কোনোভাবে ছাড় দেওয়া হবে না।’
এই পত্রিকার দাবি,‘হিযবুতের এই সদস্যের সঙ্গে তার আরও কিছু সঙ্গী উসকানিতে জড়িয়ে পড়েন। উসকানিদাতাদের মধ্যে আরও যাদের চিহ্নিত করা হয়েছে তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন আসিফ মাহতাব, হাজ্জাজ আহমেদ অয়ন, ইমরান হোসেন, মো. শহিদ প্রিজনার, শাহজাদা, এস এম রিয়াত শাহরিয়ার অর্ণব ও তুহিন তুষার।
এ সময় শ্মশ্রুম-িত এক যুবক চিৎকার করতে করতে বলতে থাকেনÑবসুন্ধরা গ্রুপকে ছাড় দেওয়া হবে না। এ কথা বলার পরপরই অন্য যুবকরা করতালি দিয়ে ‘বিচার চাই, বিচার চাই’ বলে স্লোগান দিতে থাকেন। রাতে এসব হামলা ও অপতৎপরতার সময় কয়েকজন পায়জামা-পাঞ্জাবি পরা যুবককে দেখা যায়।’
এখানে আমরা নজর দিচ্ছি এই ‘শ্মশ্রুম-িত’ এবং ‘পায়জামা-পাঞ্জাবি’ শব্দগুলোর দিকে। অর্থাৎ মুখে দাড়ি থাকলেই বা কেউ পায়জামা পাঞ্জাবি পরলেই তাকে সহজে জঙ্গি বলে চিহ্নিত করার যে প্রবণতা, পত্রিকাটি সেই ক্লিশে এবং বিতর্কিত পদ্ধতিই প্রয়োগ করেছে। আবার ফেসবুকে ‘শ্মশ্রুম-িত’ ওই যুবক ‘ইনশাল্লাহ’ শব্দটি ব্যবহার করায় সেটিও বেশ গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখ করা হয়েছে সংবাদে। অর্থাৎ কেউ ‘ইনশাল্লাহ’ বললেই ধরে নেয়া যাচ্ছে যে, সে আসলে জঙ্গি!
প্রশ্ন হলো, যে শিক্ষার্থীদের নাম পরিচয় ও ছবি দিয়ে জঙ্গি বলে প্রচার করা হলো, তাদের যদি আসলেই জঙ্গি সম্পৃক্ততা না থাকে, তাহলে তাদের জীবন কেন এভাবে অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দেয়া হলো? কারণ এই তরুণ ও যুবকদের প্রত্যেকেরই ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক জীবন আছে। যেভাবে তাদের ছবি প্রকাশ ও প্রচার করা হয়েছে, তাতে তাদের সামাজিক মর্যাদা হানি হয়েছে এবং প্রতিবেশীদের কাছে তারা আতঙ্কের নামে পরিণত হয়েছে।
জঙ্গি সম্পৃক্ততা থাকুক বা না থাকুক, এই যুবকরা চিহ্নিত হয়ে গেছেন এবং কোনো প্রতিষ্ঠান তাদের চাকরি দেবে কি না, সন্দেহ। কারণ কেউ জঙ্গি হোক বা না হোক, অভিযুক্ত করলেই মানুষের মধ্যে একটা ভয় তৈরি হয়। এই যুবকদের ব্যাপারে পত্রিকাগুলো যে ভয় তৈরি করে দিয়েছে, তাতে তাদের নিজেদের তো বটেই, পরিবারের জীবনও অনিশ্চিত করে ফেলেছে।
দ্বিতীয় প্রশ্ন হলো, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী না বললেও কিছু গণমাধ্যম তাদের নিজেদের স্বার্থে আঘাত লাগার কারণে যেভাবে কিছু লোককে জঙ্গি বানিয়ে দিলো, তাতে এটি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এখতিয়ারকে চ্যালেঞ্জ করে কি না? কোনো গণমাধ্যমই যদি এটি বলে দেয় যে অমুক লোক জঙ্গি, তাহলে দেশে গোয়েন্দা বাহিনী বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী থাকার প্রয়োজন আছে কি না? যদি ওই যুবকরা সত্যিই জঙ্গি হয়ে থাকেন, তাহলে ঘটনার সময় সেখানে পুলিশ কেন তাদের গ্রেপ্তার করল না? সবশেষ প্রশ্ন, যদি ওই যুবকরা জঙ্গি না হন, তাহলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কেন ওই সংবাদের প্রতিবাদ করলো না? নাকি কর্পোরেট পুঁিজর ক্ষমতার কাছে তাদেরও আত্মসমর্পণ করতে হয়!
এ প্রসঙ্গে অ্যাকাডেমিক তর্কের বেলায় প্রশ্ন ওঠে, গণমাধ্যম আসলে কতটা গণমাধ্যম? অর্থাৎ জনগণের স্বার্থে এই মাধ্যম কতটা ব্যবহৃত হয় আর এর মালিক এবং বিজ্ঞাপনদাতা বা কর্পোরেট স্বার্থ কতটুকু রক্ষা করে, তা বরাবরই গণমাধ্যম সম্পর্কিত আলোচনার একটি মুখরোচক ও আগ্রহোদ্দীপক বিষয়।
কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে গণমাধ্যমের মালিকরা বরাবরই তাদের সংবাদমাধ্যমকে ব্যবহার করেন ব্যবসায়িক স্বার্থে। আরও পরিস্কার করে বললে, কেউ কেউ এসব সংবাদমাধ্যম চালু করেন অন্যান্য ব্যবসা নিরাপদ করা এবং সেইসাথে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় আনুকূল্য পাওয়ার স্বার্থে। এতেও সাধারণ মানুষের খুব অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। কারণ যিনি শত শত কোটি টাকা বিনিয়োগ করে গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান চালু করবেন, সেখান থেকে তিনি কিছু সুবিধা নিতেই পারেন। মালিক চাইতেই পারেন যে, তার চেহারাটা তার টেলিভিশন একটু বেশি করে দেখাক। এতে সাধারণ মানুষের গোস্বা করার কোনো কারণ নেই।
কিন্তু অনেক সময়ই এসব গণমাধ্যম কর্পোরেট পুঁজির দাসে পরিণত হয়। যখন এসব সংবাদমাধ্যমে যুক্ত সাংবাদিকরা নিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ঠ থাকতে পারেন না। যখন তারা মালিকের অন্যায়,অন্যায্য ও অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত মেনে নিতে বাধ্য হন। যখন তারা নিজেদের বেতন-ভাতা, ক্যারিয়ার এবং অনেক সময় অন্যান্য বৈধ-অবৈধ সুযোগ-সুবিধা হারানোর ভয়ে কোনো প্রতিবাদ করেন না বা করতে পারেন না। তখন ব্যক্তিগতভাবে সাংবাদিকরা যত লাভবানই হোক না কেন, আখেরে ক্ষতিগ্রস্ত হয় গণমাধ্যম, ক্ষতিগ্রস্ত সাংবাদিকতা, ক্ষতিগ্রস্ত হয় পেশাদারিত্ব।
গণমাধ্যমকে কর্পোরেট পুঁজির স্বার্থে ব্যবহার যে কেবল বাংলাদেশেই হয়, তাই নয়; বরং এটি খোদ যুক্তরাষ্ট্রেও হয় এবং সেটি অনেক সময় বাংলাদেশের চেয়েও ভয়ঙ্কর। যার বড় উদাহরণ ২০১৬ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। ভোটের আগের দিন পর্যন্ত অধিকাংশ গণমাধ্যমের খবরে ডেমোক্রেট প্রার্থী হিলারি ক্লিনটনের জয়ের আভাস দেয়া হয়। বিভিন্ন সংবাদপত্রের জরিপও সে কথা বলে। এসব রিপোর্ট দেখে এটি বোঝার কোনো উপায় ছিল না যে শেষমেষ রিপাবলিক ডোনাল্ড ট্রাম্পই হচ্ছেন পরবর্তী মার্কিন প্রেসিডেন্ট। কিন্তু গণেশ উল্টে দিয়ে তুমুল বিতর্কিত, সমালোচিত, নিন্দিত এমনকি উন্মাদ বলে পরিচিত লোকটিই মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন এবং নির্বাচিত হবার পর শুরুতেই তিনি আক্রোশ ঝাড়তে শুরু করেন এই গণমাধ্যমের ওপর।
দায়িত্ব নেয়ার কিছুদিনের মাথায় তিনি প্রেসিডেন্টের বাসভবন হোয়াইট হাউসের এক সংবাদ সম্মেলনে সিএনএন, বিবিসির মতো নামকরা সংবাদপত্র ও টেলিভিশন নেটওয়ার্কের সাংবাদিকদের ঢুকতে না দিয়ে কড়া সমালোচিত হন। গণমাধ্যমকে ‘ফেক নিউজ’ বা ভুয়া খবরের জন্য তীব্র ভাষায় আক্রমণের কয়েক ঘন্টা পরেই ট্রাম্পের প্রেস সেক্রেটারি শন স্পাইসার সাংবাদিকদের হোয়াইট হাউজে ঢুকতে না দেয়ার ওই পদক্ষেপ নেন। ট্রাম্প মনে করেন, গণমাধ্যম কখনো সত্য প্রকাশ করতে চায় না। এক্ষেত্রে তাদের নিজস্ব কিছু বিষয় রয়েছে।
২০১৭ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি তিনি এক টুইটবার্তায় লেখেন,‘ভুয়া গণমাধ্যম আমার শত্রু নয়, আমেরিকানদের শত্রু’। ওইদিন বেশ কয়েকটি গণমাধ্যমের সরাসরি নামও নেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। এসবের মধ্যে রয়েছে, নিউ ইয়র্ক টাইমস, এনবিসিএন নিউজ, এবিসি, সিবিসি, সিএনএন। তিনি হোয়াইট হাউসে কর্মরত বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের সাংবাদিকদের যে বার্ষিক ভোজের অনুষ্ঠান হয়, তাও বর্জন করেন।
সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ট্রাম্পের এই বিদ্বেষের মূলে প্রধানত দুটি কারণ চিহ্নিত করা যায়। এক. অভিবাসী ইস্যুতে ট্রাম্পের কড়া অবস্থানের সঙ্গে মূলধারার অধিকাংশ গণমাধ্যমের বিপরীত অবস্থান; দুই. ভোটের প্রচারকালে অধিকাংশ গণমাধ্যমই কাজ করেছে ডেমোক্রেটদের হয়ে। ভোটের সময় সাংবাদিকতার নিরপেক্ষতার নীতি উপেক্ষা করে বেশির ভাগ বড় পত্রিকা ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালিয়েছে। নিউ ইয়র্ক টাইমস, ওয়াশিংটন পোস্ট, ওয়াল স্ট্রিট জার্নালসহ যুক্তরাষ্ট্রের মূল ধারার সংবাদমাধ্যমের প্রথম সারির পত্রিকাগুলো প্রকাশ্যে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে নিজ নিজ অবস্থান ঘোষণা করেছিল। সম্পাদকীয় নিবন্ধসহ প্রচুর বিশ্লেষণী লেখায় পত্রিকাগুলো বলেছিলÑকেন ডোনাল্ড ট্রাম্পকে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট করা উচিত হবে না।
অর্থাৎ গণমাধ্যম একটি গোষ্ঠীর পক্ষে দাঁড়াতে গিয়ে আরেকটি পক্ষকে শত্রু বানিয়ে ফেলে। এখানেও রয়েছে কর্পোরেট স্বার্থ। সব সংবাদমাধ্যমই কোনো না কোনো কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের মালিকানাধীন। ফলে তারা যখন নিজেদের স্বার্থের দ্বন্দ্ব বা কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্টে জড়িয়ে পড়ে, তখন আর সাংবাদিকতায় বস্তুনিষ্ঠতা বলে কিছু থাকে না। এটি যুক্তরাষ্ট্রের বেলায় যেমন সত্যি, বাংলাদেশের বেলায়ও তাই।